সিসাকে সোনায় পরিণত করলেন বিজ্ঞানীরা | Atomic Vision BD

ভূমিকা

সোনার প্রতি মানুষের মোহ চিরন্তন। সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ বিভিন্নভাবে সোনা তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। আলকেমি, যার মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ ধাতু থেকে সোনা তৈরি করা, বহু শতাব্দী ধরে ইতিহাসের পাতায় রহস্যঘেরা কল্পনা হয়ে থেকেছে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে, আরব বিশ্বে কিংবা প্রাচীন চীন ও ভারতের সাধকেরা চেষ্টা করেছেন সীসা, পারদ বা তামার মতো সাধারণ ধাতুকে সোনায় রূপান্তর করার। যদিও বিজ্ঞান ধীরে ধীরে আলকেমিকে সরিয়ে দিয়ে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে বস্তুজগতের প্রকৃত গঠন ব্যাখ্যা করেছে, তবুও মানুষের কল্পনায় সীসা থেকে সোনা তৈরির স্বপ্ন অমলিন থেকেছে।

এই স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্মিলনে। সুইজারল্যান্ড-ফ্রান্স সীমান্তে অবস্থিত ইউরোপিয়ান পার্টিকেল ফিজিক্স রিসার্চ সেন্টার, CERN–এর ALICE (A Large Ion Collider Experiment) গবেষণাগারে পরিচালিত এক পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এক বিস্ময়কর ঘটনা—বিশেষ পারমাণবিক সংঘর্ষের মাধ্যমে সীসা নিউক্লিয়াস থেকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সোনার নিউক্লিয়াস তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।




গবেষণার প্রেক্ষাপট

CERN-এর Large Hadron Collider (LHC) হল বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর। এটি মূলত মহাবিশ্বের সৃষ্টি-পরবর্তী ক্ষুদ্র সময়ে কী ধরনের পদার্থ ও শক্তির বিক্রিয়া ঘটেছিল তা অনুকরণ করার জন্য তৈরি। LHC-এর মধ্যে ALICE নামের পরীক্ষাটি কণাপদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যা বিশেষভাবে ভারী আয়নের সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ করে।

এই গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে এক ধরনের সংঘর্ষ ব্যবস্থা যাকে বলা হয় ultra-peripheral collision (UPC)। এই সংঘর্ষে, দুইটি ভারী আয়ন (এই ক্ষেত্রে সীসা, অর্থাৎ Pb-208) একে অপরের খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে কিন্তু সরাসরি ধাক্কা খায় না। তবে তাদের চারপাশের প্রবল ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্র একে অপরের ওপর এমন প্রভাব ফেলে যে ফোটন বিনিময়ের মাধ্যমে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বিক্রিয়া ঘটে।

এই বিক্রিয়ায়, সীসা নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে হঠাৎ করে তিনটি প্রোটন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে নতুন একটি নিউক্লিয়াস গঠিত হয়—Au-205, অর্থাৎ স্বর্ণের একটি আইসোটোপ।


গবেষণার ধরন ও পর্যবেক্ষণ

২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত Run 2 নামে পরিচিত এক পরীক্ষামূলক পর্বে ALICE ডিটেক্টর ব্যবহার করে এই ধরনের সংঘর্ষের লক্ষ লক্ষ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি সংঘর্ষেই বিজ্ঞানীরা দেখেছেন কীভাবে সীসা থেকে সোনার নিউক্লিয়াস তৈরি হচ্ছে। যদিও প্রতিটি সোনার নিউক্লিয়াস খুবই ক্ষণস্থায়ী—মাত্র কয়েক মিলিনিশেকেন্ড (1 মিলিসেকেন্ড = 0.001 সেকেন্ড)—তবুও ALICE-এর অত্যাধুনিক ডিটেকশন প্রযুক্তি এই ঘটনাগুলোকে শনাক্ত ও রেকর্ড করতে পেরেছে।

পুরো Run 2 সময়কালে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন সোনার নিউক্লিয়াস সনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর মোট ভর ছিল মাত্র ২৯ পিকোগ্রাম। (১ পিকোগ্রাম = এক ট্রিলিয়নের এক ভাগ গ্রাম)। অর্থাৎ, ভর হিসাবে এতটাই ক্ষুদ্র যে তা চোখে দেখা বা স্পর্শযোগ্য নয়। এরপর ২০২২ সাল থেকে শুরু হওয়া Run 3 এ গবেষণাটি নতুন মাত্রা পায়, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৮৯,০০০ সোনার নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার হার রেকর্ড করা হয়।

এই পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ALICE ডিটেক্টরের Zero Degree Calorimeter (ZDC), যা মূলত সংঘর্ষে উৎপন্ন নিরপেক্ষ কণাগুলিকে শনাক্ত করে।


বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ

এই ঘটনাটি আসলে একধরনের nuclear transmutation বা পারমাণবিক রূপান্তর। সীসা নিউক্লিয়াসে মোট ৮২টি প্রোটন থাকে। কিন্তু যখন তিনটি প্রোটন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন এর প্রোটনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৯—যা সোনার নিউক্লিয়াসের বৈশিষ্ট্য। এধরনের রূপান্তর প্রাচীন আলকেমিস্টদের “সীসা থেকে সোনা” কল্পনার বাস্তব রূপ।

এখানে ব্যবহৃত ফোটন-নিউক্লিয়াস ইন্টার‌অ্যাকশন একধরনের electromagnetic dissociation, যা পূর্বে তাত্ত্বিকভাবে অনুমান করা হয়েছিল, কিন্তু প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে।

এটি পদার্থবিজ্ঞানে এক বড় অর্জন, কারণ এটি আমাদের beam dynamics, accelerator design, এবং nuclear interaction সম্পর্কে পূর্বধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং নতুন মডেল উন্নয়নে সহায়তা করে।


গবেষণার প্রয়োগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

এই গবেষণা এখনো পর্যন্ত পরীক্ষামূলক স্তরেই সীমাবদ্ধ এবং একে অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর প্রক্রিয়া বলা যায় না। কারণ একটি সোনার আংটি তৈরি করতে যতটা পরিমাণ স্বর্ণ দরকার, তা তৈরি করতে কোটি কোটি সংঘর্ষ ঘটাতে হবে এবং এতে লাগবে কয়েকশ বছর ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।

তবে এর ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানে। এটি ভবিষ্যতের এক্সিলারেটর ডিজাইন, রেডিয়েশন ড্যামেজ স্টাডি, নিউক্লিয়ার অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, এমনকি মহাবিশ্বের ভারী মৌলগুলোর উৎপত্তি বুঝতেও সহায়তা করবে।

এ ছাড়া, এটি “beam-loss modeling”–এ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, যেটি বড় বড় পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


ঐতিহাসিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ

এই গবেষণাকে কেবল একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলে ক্ষান্ত করা যায় না। এটি এক অর্থে ইতিহাসের চক্র পূর্ণ হয়েছে বলেও ধরা যায়। হাজার বছর আগে যে স্বপ্ন নিয়ে আলকেমিস্টরা রসায়ন, ধাতুবিদ্যা ও দর্শনের পথ খুঁজে বেড়িয়েছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞান সেই পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখিয়েছে—হ্যাঁ, সীসা থেকে সোনা তৈরি সম্ভব, যদিও ভিন্ন পদ্ধতিতে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে এবং ভিন্ন মাত্রায়।

এই আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞানের সৌন্দর্য কেবল তার কার্যকারিতায় নয়, বরং তার কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতায়। বিজ্ঞান কেবল ভবিষ্যতের দিকে নয়, ইতিহাসের গভীর অতীতের সঙ্গেও যুক্ত।


উপসংহার

CERN-এর ALICE পরীক্ষাগারে সম্পন্ন এই গবেষণা নিঃসন্দেহে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী মাইলফলক। এটি প্রমাণ করেছে যে, কল্পনার সীমানাও একদিন পরীক্ষাগারের চার দেয়ালে বন্দি হতে পারে। মধ্যযুগীয় রূপকথার অলৌকিকতা আজ পরমাণুর গভীরে আবিষ্কৃত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।

এই গবেষণার মাধ্যমে কেবল একটি পারমাণবিক রূপান্তর নয়, বরং বিজ্ঞান ও ইতিহাস, কল্পনা ও বাস্তব, প্রাচীন ও আধুনিকের এক অনন্য সংমিশ্রণ ঘটে গেল।


প্রকাশনা:
📄 Title: Ultra-peripheral lead-lead collisions at the LHC producing gold nuclei
📚 Journal: Physical Review C
🔗 DOI: 10.1103/PhysRevC.111.054906

No comments

Powered by Blogger.